Our Books: Niritater Alokay Bedia Jonojathi (Bengali)
Raktim Das
price:Rs,100/- India & Bangladesh: 100 tk.
অস্থির সময়ের এলোমেলো কথা...
সুকুমার রায়ের বাবুরাম সাঁপুড়ে ছোটবেলায় পড়েছিলাম। মায়ের মুখে এই ছড়া শুনে ওই মানুষগুলো প্রতি কেমন যেন একটা আর্কষণ তৈরি হয়। বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। চাকরির দায়িত্বের ফাঁকে সময় পেলেই তার শখ ছিল ম্যাজিক দেখানো। ছোটবেলা থেকে তার হাতসাফাইয়ের খেলা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এখন মনে হয়, যদি আমার সাধ্য থাকত তাহলে বাবার হাত দুটো বীমা করতাম। কি অবলীলাক্রমে তিনি পয়সা থেকে পেপারওয়েট ভ্যানিস করতে পারতেন। সেই সময় আমাদের বাড়িতে আসতেন মাদারি যাদুকররা। তাদের কাছে দেখে ছিলাম প্রথম থট রিডিং এর খেলা। যাকে বলে মাদারির খেলা। এরপর একটু বড় হয়ে শুরু করলাম বিভিন্ন প্রাণী পোষা। তবে সবার মতো পায়রা, কুকুর বা মাছ পোষা নয়। আমার পোষ্য ছিলÑ আরশোলা, ইদুর, ব্যাঙ- এমনকি ছারপোকাও বাদ যেত না। কাঁচের জারে ভরে দিনের পর দিন লক্ষ্য করতাম এদের বিচিত্র গতিবিধি। পাড়ায় সাপুড়িয়া, বাঁদরওলা বা ভল্লুকওলা এলে আমি তাদের পিছু নিতাম। খেলা দেখানো সময় বসে বসে দেখতাম কীভাবে তারা এই প্রাণীদের বশ করেন। পড়তাম বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে। পরিবারের চাপে প্রথাগত শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় হলেও আমার মন টানতো ওই বিচিত্র পেশার মানুষগুলোর প্রতি। আমার মনোজগত সবসময়ই বিচরণ করতো ওই তথাকথিত অলৌকিক মানুষগুলোকে ঘিরে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার বারুইপুরের নানু সাপুড়িয়ার সঙ্গে আলাপ হল। ও আমার কাছে মাদুলি বিক্রি করতে চাইলো, কিন্তু ততোদিন আমি জেনে গেছি, সাপকে মাদুলি দিয়ে বশ করা যায় না। তাই আমাকে জানতেই হবে সাপ আর ওদের জীবনাচরণ সম্বন্ধে। একটা জেদ চেপে গেল সেময়টায়। সেই জেদ আমাকে নিয়ে গেল বারুইপুরের গোলপুকুরে ওদের আবাসস্থলে। সেসময় থেকেই প্রতি রবিবার আমি সকালে ছুটে যেতাম ওদের কাছে। বাড়ি থেকে হাত খরচার জন্য পাওয়া টাকা দিয়ে বারুইপুরে যাতায়াত করা যেত না; তাই বাডির কাছের বাঘাযতীন স্টেশন থেকে ট্রেনে না চেপে, সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম সেখানে। প্রথমে ওরা আমাকে পাত্তাই দিতনা। পরে জেনেছিলাম আমার মতো আরও একজন এইভাবেই ওদের কাছে এসেছিল- ওদের সম্বর্কে জানার উদ্দেশ্যে। সেই ব্যক্তি বেদিয়াদের থেকে সব শিখে পরবর্তীতে সর্পবিদ হিসেবে সমাজে নিজের স্থান করে নেন। কিন্তু যে সম্প্রদায়ের মানুষদের থেকে তিনি সর্প সম্পর্কে শিক্ষা নিলেন তাদের দিয়েই ব্যবসা শুরু করলেন। যৎসামান্য টাকায় তিনি বেদিয়াদের থেকে সাপ কিনে বিষ সংগ্রহ করে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করছেন। বেদিয়ারা সাপ বিক্রি করলেও এর বিষের দাম কতো তা জানেনা বেশিরভাগ বেদিয়াই। এমনকি এও জানেনা, কার কাছে কিভাবে এ বিষ বিক্রি করতে হয়। তাই মুনাফার পাহাড় জমে অন্যের ঘরে, স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পর আজও এরা না ঘরকা না ঘাটকা। এ কারণেই বারুইপুরের বেদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো এখন তাদের সমাজের বাইরের আর কাউকেই বিশ্বাস করতে চায়না। আমি দীর্ঘদিন ধরে, তাদের সান্নিধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করি। এক সময় আস্থা অর্জন করতে কিছুটা সক্ষম হই। তখন জানতে পারি, সাপ বেষ্টিত পেশার বাইরেও এদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। রয়েছে নিজের একটি ভাষা। তার নাম ‘মাঙতা’। শিখলাম ওদের ভাষা, জানলাম ওদের প্রাচীন সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির নতুন নতুন উপাদান প্রতিদিনই আমার সংগ্রহে আসতে লাগলো। এই হতদরিদ্র নিরন্ন মানুষগুলো নিজেরা না খেয়ে আমাকে খাওয়াতো। বিশবছর ধরে ঘুরে বেড়ালাম ওদের সঙ্গে যাযাবরের মতো ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের বেদে পাড়াগুলোতে। গেলাম বাংলাদেশের বেদে পাড়ায়। এরই মধ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু হল। সমাজপরিবর্তনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে ভাবলাম এই মানুষগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতিতেই রেখে কীভাবে সমাজের মূল স্রোতে আনা যায়। দেখলাম আসলে আমরা মানে, তথাকথিত সভ্য মানুষরা দায়ী ওদের এই দুরবস্থার জন্য। আমাদের শিক্ষার বড়াই আর পয়সার লোভই ওদের সমাজের চোখে করেছে ব্রাত্য। তাই ওরা আমাদের বিশ্বাস করে না। ১৯৭২ সালে দিল্লির যন্ত্রচালিত শীতল ঘরে বসে কিছু সভ্য শিক্ষিত মানুষ(!) যারা নিজেদের পরিবেশবিদ বলেন তারা কলমের খোঁচায় আইনের নামে ওদের হাত থেকে সাপ কেড়ে নিলেন। আর একবারও ভাবলেন এই কয়েক লক্ষ মানুষের পেটের ভাত কীভাবে জুটবে? সাপকে বন্যপ্রাণীর আওতায় ফেলে এই সুপ্রাচীন সংস্কৃতির ধারক বাহকদের পঙ্গু করে দিলাম আমরা। আজ যখন আমরা পরিবর্তনের কথা বলি সবসময়, তখন বলতে ইচ্ছা করে কীসের পরিবর্তন? যার হাতে পয়সা আছে তার আরও পয়সা। আর যে গরীব সে আরও গরীব। এটাই পরিবর্তন!! কবিগুরু কথায় ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে...’।
এই বোধের জায়গা থেকেই হয়তো ভাবনাটা এসেছিল ওদের জন্য কিছু করার। একবার অন্তত বলার, কেন আমরা জানবো এদের ইতিহাস, সংস্কৃতির কথা। তাই এই গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নিই। আমি কোনো গবেষক নই। পেশায় একজন সাংবাদিক। পথ চলতে চলতে এদের সমন্ধে যা জানতে পেরেছি, তাই লিখেছি। আর দীর্ঘ দু’যুগ ধরে ওদের সংস্পর্শে আসার কারণেই হয়তো লেখার তথ্য সংগ্রহ সহজ হয়েছে। কারণ ওরা এতো আত্মকেন্দ্রিক যে, সহজে মুখ খোলেনা। তাই হয়তো এর আগে কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারেনি। আমি শুরু করলাম। ভুল ত্র“টি থাকা খুবই স্বাভাবিক। আমার ভুলত্র“টিগুলোর সংশোধনের জন্য এবার যদি কোনো নৃতত্ত্ববিদ বা ভাষাবিদ বা ঐতিহাসিক কাজ করতে আসেন তবেই আমার এ দীর্ঘ পরিশ্রম সার্থক হবে।
বেদিয়াদের নিয়ে এ বইটি রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম সহযোগিতাকারী হিসেবে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার সন্তান আনোয়ারুল করিম রাজু। তিনি ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় চিফ রিপোর্টারসহ সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকেরও তিনি ঢাকা প্রতিনিধির দায়িত্বে রয়েছেন। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিনি আমার সুপরিচিত এবং বন্ধুও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করা রাজু’র বেদিয়াদের নিয়ে ইতোপূর্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলনা। তবে বেদিয়াদের নিয়ে আমার কাজকে সবসময়ই উৎসাহ যুগিয়েছেন। এ ধরনের গ্রন্থ রচনার কথা শুনে এর প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি প্রতিনিয়তই আমাকে তাগিদ দিয়েছেন। এজন্য তিনি আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার বেদিয়া পাড়ায় নিয়ে গেছেন। আমার অনুরোধে তিনি এই গ্রন্থের বাংলাদেশ অংশ রচনাসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং নিজ হাতে কম্পিউটারে কম্পোজ করেছেন। বইটির প্রয়োজনে তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও একাধিকবার ঢাকা থেকে কলকাতা এসে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে কখনোই কার্পণ্য করেননি। শুধু এই বই লেখাই নয়, বাংলাদেশের বেদিয়া সম্প্রদায়ের জাতিগত মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের হাত থেকে বেদিয়াদের ‘মাঙতা’ ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য আমার অনুপ্রেরণায় আনোয়ারুল করিম রাজু প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বেদিয়া ফেডারেশন অব বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বাংলাদেশের বেদিয়া জনজাতির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ওই সংগঠনটির সঙ্গে থাকতে পেরে আমিও গর্বিত।
এ বইটি লিখতে গিয়ে আরো বলতে হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বনেদী প্রকাশনালয় ‘নওরোজ কিতাবিস্তান’-এর বন্ধু চন্দনের কথা। যিনি আমাকে এ বইয়ের পান্ডুলিপির জন্য দু’বছর ধরে ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেছেন। এছাড়া আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী দেবমাল্য, বিশ্বনাথ, মৌসুমী যারা শুধু সাহায্য নয়, সাহস যুগিয়েছে। আছেন ‘ভারতের বেদিয়া ফেডারেশন’-এর আমার শ্রদ্ধেয় কালুদা, মীরুদা, আলী, অশোক আর অগণিত বেদিয়া ভাইবোনরা। যারা বিভিন্ন সময়ে বেদিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার চাহিদা অনুযায়ী তথ্য যোগাতে সহায়তা করেছে। আর রয়েছেন আমার পথপ্রদর্শক শ্রী গৌতম ব্যানার্জি, শ্রী কল্লোল মজুমদার ও শ্রী উমাশঙ্কর রায়। যারা আমার অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করেছেন, এখনও করেন। অবশ্যই আজ মনে করতে চাই আমার দুঃখের দিনের লড়াইয়ের সঙ্গী অধ্যাপক অংশুতোষ খান আর স্নেহাংশু রায়কে। আর যার কথা না বললেই নয় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র)- আমাদের মেজদা। যিনি এই বই-এর ভূমিকা লিখে আমায় কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন।
রক্তিম দাশ
কলকাতা
এপ্রিল ২০১০
No comments:
Post a Comment