‘মা মনসারে কিছু দে !

ট্যাকা দেখলে ফুতরি লাগে

হাতে পেঁচানো কালনাগিণী। কখনো হাতে, কখনো গলায়। যখন হাঁটে, কেঁপে কেঁপে ওঠে মাটি। ভয়-ডর কি, তা জানে না। খুব কৌশলে সাপটি ধরে রাখে। হাট-বাজার, মেলা-খেলা আর নানা উৎসবে যায় ফুকা (গাওয়াল করে টাকা উপার্জন করা) করতে। কালনাগিণীর মাথা থাকে সামনের দিকে। অনেক সময় ছোবল মারার চেষ্টা করে। মান্তা মেয়েটি হাসি হাসি মুখে মানুষের সামনে দাঁড়ায়। বলে, ‘মা মনসারে কিছু দে!’

মেয়েটির নাম শিল্পী। পরনে পাড়বিহীন কালো শাড়ি। গায়ে আঁটসাঁট ছোট্ট ব্লাউজ। কোমরে বিছা। নাক, কান ও গলায় সুন্দর গয়না। হাতে চুড়ি। সাজগোজ তার খুব প্রিয়। ডাগর ডাগর দৃষ্টি দু চোখে। ঠোঁটের কোণে সব সময় লেগে থাকে দুষ্টু হাসি।

মানুষের চেহারা দেখে মনের কথাটি বলে দিতে পারে অনায়াসে। তাই কখনো খালি হাতে ফেরে না। সাপ দেখে সবাই ভয় পায়। সেই সুযোগে শিল্পী টাকার জন্য হাত পাতে। তাকে টাকা না দিয়ে উপায় নেই। রাগারাগি? সেটাও কোনো কাজে আসে না। কারণ তার চাই টাকা। পেটের ক্ষুধা নিবারণ এবং ফুর্তি (ওদের ভাষ্যমতে ফুতরি) করার জন্য মেলা টাকার প্রয়োজন। শিল্পী বলে, ‘ট্যাকা দেখলে ফুতরি লাগে!’ শিল্পীর মতো মান্তা পাড়ার অন্যান্য মেয়েরাও এই কাজ করে।

যখন হেঁটে যায় ধাই ধাই, রাস্তার মানুষজন তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। আমল দেয় না খুব একটা। গল্প করার সময়ও শিল্পীর হুঁশ থাকে না। একটা গল্পের সাথে আর একটা গল্পের ডালপালা জড়িয়ে ফেলে। আঁচল পড়ে গেলেও সেদিকে খেয়াল থাকে না। গল্প করেই চলে। আজ যার সাথে পরিচয়, তার সঙ্গেও।

বাড়ির পাশে আরশিনগর

সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ১৫-২০ টাকা রিকশা ভাড়া। এলাকার নাম পোড়াবাড়ি হলেও মান্তাদের বসবাসের কারণে মান্তাপাড়া বললেও সবাই চেনে। সাপুড়েপাড়া বা বাইদাপাড়া বললেও ক্ষতি নেই। যেটা বলে শান্তি লাগে বলবেন। তবে মান্তারা দাবি করে মান্তাপাড়া। প্রায় ১৫ হাজার মান্তা বসবাস করে এই এলাকায়।

মান্তারা দু ভাগে বিভক্ত। যারা সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায় এবং নানারকম গাছগাছালির ওষুধ বিক্রি করে তাদের বলা হয় মান্তা। আর যারা ব্যবসার জন্য নৌকায় নৌকায় ঘোরে, দাঁতের পোকা খোলে এবং চুড়ি বিক্রি করে তারা হলো সান্ধার। মান্তা এবং সান্ধার একই এলাকায় পাশাপাশি বসবাস করে। শিল্পী হলো মান্তা। ওর কথাবার্তা, আচার-আচরণ আলাদা। প্রতিটি বাক্যের শেষের শব্দে কিঞ্চিৎ জোর দিয়ে, টেনে টেনে সুর করে কথা বলে। যে কারণে খুব সহজেই তাকে আর দশটি মেয়ে থেকে আলাদা করা যায়।

খুব অল্প বয়সেই মান্তা মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর ওরা যে কাজটি করে তা হলো প্রেম। বাবা-মা তো দেশে দেশে ফুকা করে বেড়ায়। এমনকি ভারতের অনেক রাজ্যে পর্যন্ত তাদের বিচরণ। বাড়ি ফেওে বকরি ঈদে। কিংবা সর্দারের বিশেষ কোনো নির্দেশ থাকলেও ফিরতে হয়। মান্তারা সর্দারকে সম্মান করে।

মেয়েরা স্কুলে যায় না খুব একটা। বাবা-মা মনে করে ঝুট-ঝামেলা না বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়াই ভালো। প্রেম করলে মা-বাবা তেমন কিছু একটা বলে না। কারণ পণ। মান্তাদের মধ্যে পণপ্রথা প্রচলিত। মেয়ের বাবাকে ছেলের বাবার পণ দিতে হয়। ১০-১২ এমনকি ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত পণ নির্ধারণ হতে পারে।

শিল্পীর বয়স ১৭ কী ১৮ হলেও এখনো বিয়ে হয়নি। তার একটা গোপন ইতিহাস আছে। বিষয়টি সে যার তার সাথে শেয়ার করে না। অনেক বলে-কয়ে বের করা গেছে সেই ইতিহাস। প্রিয় পাঠক, সে গল্প জানবেন একটু পরে।

শিল্পীরা দুই বোন। ছোট বোন স্বাধীনা। বয়স ১২ বছর। চুটিয়ে প্রেম করছে। রিনরিনে হাওয়ার মতো সে সবসময় যেন বেড়াচ্ছে উড়ে উড়ে। সকালবেলাতেই মধ্য দুপুরের ডামাঢোল। বয়স কম হলে কী হবে, এরই মধ্যে সে সব জেনে গেছে। আত্মস্থ করে ফেলেছে প্রেমের জটিল কবিতা। কণ্ঠস্বর একটু মোটা। কথা বলে ঠাশ ঠাশ। কাটাকাটা চাওনি। সেও ফুকা করে।

শিল্পী ৬-৭ বছর বয়সে ফুকা করতে শিখেছে। সাপ ধরাও শিখেছে। স্মৃতিসৌধ, রমনা পার্ক, ধানমণ্ডি লেক, সংসদ ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়, সিনেমা হলের সামনে, শপিংমল, বড় বড় মার্কেট-- এসব হলো শিল্পীদের প্রিয় জায়গা। এখানে কালনাগিণী হাতে নিয়ে দাঁড়ালে কম করে হলেও ৩০০/৪০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়। অনেক সময় ৫০০ পর্যন্ত। বাড়ি যখন ফেরে তখন থাকে ক্লান্ত কিন্তু মুখের দিকে তাকালে ঠাহর করা যায় আনন্দের ঝিলিক। টাকার আনন্দ এমনই!

গোখরা সাপ দুই প্রকার

প্রত্যেক মান্তার কাছেই সাপ ধরা পানির মতো সহজ ব্যাপার। ওরা সাপ ধরার কৌশল শেখে ছোটবেলা থেকেই। মায়ের কাছে। বাবার কাছে। শিল্পীর বাবার নাম আলাউদ্দিন ওরফে আলা পাগলা (ভদ্রলোক স্বভাবে বোহেমিয়ান তাই এই নামকরণ)। সে তার মেয়েদের সাপ ধরা এবং ফুকা করার কৌশল শিখিয়েছে নিজের হাতে। বাড়ির বারান্দায় ঝাঁপির মধ্যে থাকে গোখরা সাপ। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে ওরা। তাই সাপ দেখে ভয় পাওয়ার কথা বললে শিল্পী খিকখিক করে হেসে মরে। হাসতে হাসতে বলে ‘অরা তো আমগো ভাইবইনের লাহান। ডর পামু ক্যান?’

শিল্পীর একমাত্র ছোট ভাই রব্বানি। বয়স টেনেটুনে তিন কী সাড়ে তিন বছর। সেও সাপ দেখে ভয় পায় না। আলা পাগলা যখন ঝাঁপি খুলে তার গোখরাগুলোর দেখভাল করে তখন রব্বানি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোখরারা ছোবল মারার চেষ্টা করে। রব্বানি এতে একটুও ভয় পায় না। মান্তারা কালো গোখরাকে ‘গুমা’ আর শাদা গোখরাকে বলে ‘মাসুয়ালদ’।

সাপ ধরা মন্ত্র
সাপের মন্ত্র বলে কিছু নেই। কিন্তু মন্ত্র যেটা আছে সেটা যে মিথ্যা এ কথা মান্তারা জানে। তারপরও মন্ত্রের ব্যাপারটা প্রচার করতে হয়। স্রেফ টাকা উপার্জনের জন্য। ‘সাপ তো বাপেরেও ছাড়ে না। মন্ত্রে আর কী হয়!’-- মন্ত্র সম্পর্কে সর্দারপুত্র রাজুর এমনই মন্তব্য।

শিল্পীও জানে মন্ত্রটি। অনেক সাধাসাধি করে ওর মুখ থেকে মন্ত্রটি বের করেছি। বলবার আগে শর্ত দিয়েছিলো, কাগজে টুকে নেওয়া বা রেকর্ড করা সম্পূর্ণ নিষেধ। আমি মুখস্থ করে উদ্ধার করেছি।
মন্ত্রটি এই-

রাঙ শাঙ ধামালি পিড়পিড়ে টোটো
কাটাং তুড়ি চণ্ডাল কঁও চণ্ডাল বর্মাচণ্ডাল লজ্জাবতী
বিছাটি লজ্জাবতী শিকড় কচি শিমুল গাছ
আস্তিকমণিরাজ মুনামুনি হরিচন্ড বিষল্ল
কুরুলি তুড়ক চণ্ডল চুত্রাপাতা...



সাপের বাজার

মান্তাপাড়ার প্রধান রাস্তার দু পাশে অনেকগুলো টং ঘর। টং ঘরে বেশ কয়েকটি সাপের দোকান। এখান থেকে পাইকারি ও খুচরা সাপ বিক্রি করা হয়। অন্যান্য টং ঘরে চায়ের দোকান। চাল, চাল, লবণ, তেলের দোকান। মান্তারা টং ঘরে বসে, চা খায়, তাস খেলে আর খোশগল্প করে। গাঁজা খায়। ছেলেমেয়ে বলে কথা নেই। সবাই। হাসাহাসি, হই হল্লা। দূর থেকে সাপ কিনতে আসা পুরুষরা মান্তা মেয়েদের দিকে যদি আড়ে-টাড়ে চায় তাহলে মেয়েরা বলে, ‘কি রে সাপের রগে কি আমগোও লিবি নাকি?’

গোখরা সাপ বিক্রির আগে বিষদাঁত ফেলে দেয়। বটি বা চাকু দিয়ে বিষ ফেলার সময় সাপের বিষ ছিটকে এসে পড়ে মান্তাদের হাতে বা শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিষ ওরা ধুয়েও ফেলে।

এক্কেবারে ফুটা কইরা দিমু

এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে শিল্পী টাকা আদায় করে না। ওদের কাছে ভদ্র-অভদ্র, ধনী-গরিব, মন্ত্রি-মিনিস্টার সবাই সমান। সবার সাথে কথা বলে তুই তুকারি করে। ওরা কাউকে ভয় পায় না। ক্ষেত্র বিশেষে বেশ ভয়ঙ্করও হতে পারে। বিদেশী জুটি পেলে মহাখুশি। কারণ বিদেশীদের কাছ থেকে বেশি টাকা খসানো সহজ। কিন্তু শিল্পী তো বিদেশী ভাষা জানে না। তাই হাতের ইশারায় সাপের জন্য কিছু চায়। বিদেশীরা হাসে। হয়তো জানতে চায় টাকা দিলে কী হবে। শিল্পী দু হাতের বন্ধন দেখায়। মানে শিগগিরই মিলন হবে।

অন্য মান্তা মেয়েদের মতো শিল্পীও খুব সহজ-সরল। কিন্তু কখনো যদি কেউ রাগিয়ে দেয় তাহলেই বিপদ। তখন গলায় সাপ পেঁচিয়ে দেবে। একবার এ-রকম ঘটনা ঘটেছিলো ঢাকা শহরের এক অফিসের দারোয়ানের সাথে।

দারোয়ান শিল্পীর দিকে বন্দুক তাক করে বলেছিলো, ‘এক্কেবারে ফুটা কইরা দিমু-- এক্কেবারে ঝাঝড়া কইরা দিমুÑঐ যে দেখছস, রাস্তায় তর বাপের বাপ সার্জন খাড়াইয়া খাড়াইয়া সিগারেট খাইতেছে।’
শিল্পী দারোয়ানের কথা শুনে তো হেসে খুন। যদিও ভেতরে ভেতরে ঠিকই রেগে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ানের গলায় তার কালনাগিণীটি পেঁচিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আরে বেটা, তুই আমারে সার্জনের ডর দ্যাখাস, আমরা অগো থিকাও ট্যাকা লই। অরা উঠতে বইতে আমাগো সালাম ঠুকে।’

দারোয়ান তখন ভয়ে কান্নাকাটি করে মরে। কোথায় যে ছিটকে পড়ে তার বন্দুক। বুঝতেই পারে না সে। অফিসের ম্যানেজার এসে সমস্যার সমাধান করে।

সর্দার

মান্তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয় না। সর্দার যা বলে, তাই ঠিক। এমনকি বিচার-সালিশ সব করে সর্দার। থানা-পুলিশ এড়িয়ে চলে ওরা। সর্দারের ছেলে সর্দার হবে এটাই নিয়ম। শিল্পী মনে করে বিয়ের রেজিস্ট্রি হওয়া দরকার।

হাসনা ফুলের গন্ধ

অনেকেই আছে যারা টং ঘরে গল্প করতে করতে সারাদিন কাটিয়ে দেয়। অবসর সময়ে শিল্পীও বসে গিয়ে টং ঘরে। তার ভাণ্ডারে গল্প কম। কোথায় গেলে টাকা বেশি কামানো যায়-- এটাই তার গল্পের বিষয। যেমন : ইস্টুডিয়ানরা (স্টুডেন্ট) বাপের হোটেলে খায়, তাই তাদের টাকা পয়সা কম। যারা সিনেমা দেখতে আসে, তাদের পকেটে টাকা থাকে। যারা গাড়িতে চলে, তারা তো বড় লোক। এদের সামনে গিয়ে শিল্পী দাঁড়ায়। পারলে সাপের ছোঁয়া দেয়। মানুষগুলো তখন ভয়ে মরে। তখন কিছু বলতেও হয় না। তাড়াতাড়ি টাকা বের করে। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকা? পার্কে পার্কে তো এদের আনাগোনাই বেশি। কালনাগিণী দেখামাত্র এরা পকেটে হাত দেয়। তবে শিল্পী তাদের খুব একটা ধরে না। কেননা কোনো জুটি দেখলেই নিজের কথা মনে পড়ে যায়। ওর সমবয়সীরা এখন ২-৩ জন সন্তানের মা। ১২-১৩ বছর বয়সে সেও প্রেম করেছিলো টেপুর আলীর সাথে। একটানা ৪-৫ বছর। কিন্তু শখ করে জ্ঞানী হওয়ার আশায় টেপুর আলী গেলো কামরূপ-কামাখ্যায়। সেই যে গেলো, আর ফিরে এলো না। শিল্পী এখন খায়-দায়, ফুকা করে, গল্প করে, হাসাহাসি করে। কিন্তু মনের মানুষের কথা মনে হলে তার সব কিছু ম্লান হয়ে যায়। শুধু কান্না আসে। কিছুই ভালো লাগে না। তার এই একতরফা গভীর প্রেম দেখে সবাই হাসে। গত বছর সর্দারপুত্র রাজুর সাথে তার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিলো। শিল্পী রাজি হয়নি। তার একটাই কথা, বিয়ে যদি করতে হয় তাহলে টেপুর আলীকেই করবে। আর কাউকে নয়।

টেপুর আলীর কথা মনে হলে তার কিছুই ভালো লাগে না। মাঝে-মধ্যে খুব গোপনে টেপুর আলীর জন্য কাঁদে। নিজেই নিজেকে আবার সান্ত¡না দেয়। ভাবে, একদিন ফিরে আসবে। তার মনের কষ্ট কেউ দেখে না। শুধু বাইরের হাসিখুশি আর সাজগোজ দেখে।

শিল্পীর একটা প্রিয় গান আছে। টেপুর আরীর কাছ থেকে শেখা। গানটি গুনগুন করে গাইলে মনের কষ্ট দূর হয় :

হাসনা ফুলের গন্ধে ভরা
তোমার মুখের হাসি
তোমায় বিনা একলা আমি
নয়ন জলে ভাসি॥

No comments: